একটি স্বপ্ন পূরন এর গল্পঃ
################
কলেজে উঠলেই নাকি ছেলেপুলেদের পাখনা গজায়। কলেজে উঠে আমারও পাখনা গজিয়েছিল। সেই পাখনা গজানোর ইতিহাস বলতে হলে একটু প্রাক ইতিহাসও বলতে হয়, নয়তো আমার পাখনা কত বড় হয়েছিল তা বোঝানো যাবে না।
পড়াশোনার ব্যপারে আমার উপর আব্বার কোন কালেই আস্থা ছিল না। সে জন্য এসএসসি পরীক্ষার আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন আমি ফার্স্ট ডিভিশন পেলে আমাকে বিমানে কক্সবাজার নিয়ে যাবেন। তিনি যে সময়ে এ ঘোষণা দিয়েছেন তখন আমাদের পরিবারের কেউই বিমানে চড়েনি, আবার কেউ কক্সবাজারও যায়নি। তাই এ ঘোষণা দেয়ার অর্থ ছিল, আব্বা নিশ্চিত ছিলেন যে, আমার পক্ষে ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া সম্ভব নয়।
শেষ পর্যন্ত আব্বার ঘোষণা অনুযায়ী বিমান নয় বরং রকেটে চড়ার যোগ্যতা নিয়ে এসএসসি পাস করলাম। আমার জন্য সবচেয়ে ভয়ের সাবজেক্ট ইংরেজি ছাড়া বাকি সব বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্কস পেলাম।
এখনকার জেনারেশনের জন্য একটু বলে রাখি, স্টার মার্কস মানে মোট ১০০০ নম্বরের পরীক্ষায় ৭৫০ বা তার বেশি নম্বর পাওয়া। কোন বিষয়ে ১০০ তে ৮০ বা তার উপরে পেলে তাকে লেটার মার্কস বলা হতো। ফার্স্ট ডিভিশন ছিল ১০০০ এ ৬০০ বা তার বেশি আর সেকেন্ড ডিভিশন ছিল ১০০০ এ ৪৫০ বা তার বেশি। এই লেখার পরের অংশে কাজে লাগবে বলে সেকেন্ড ডিভিশনের হিসাবও এখানে দিয়ে দিলাম।
তো, এসএসসিতে আমার এ সাফল্যের ফল স্বরূপ আমাকে বিমানে কক্সবাজার না নিলেও আব্বা আমার স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা একেবারেই ছেড়ে দিলেন। ফলে আমার পাখনা গজিয়ে উঠতে আর কোন বাধা রইল না।
কলেজ ক্যাম্পাসটি আমার জন্য নতুন কিছু নয়। কেননা, স্কুলে থাকতেই সময়ে সময়ে কলেজের মাঠে খেলতে আসতাম। ঢাকা কলেজের উত্তর দিকের দেয়ালের ওপাশেই ছিল আমার সরকারি ল্যাবরেটরি হাইস্কুল। তাই কলেজে ভর্তি হওয়ার পর একে নিজের বাড়ির মতোই মনে হতো। তাছাড়া, স্কুলের পুরোনো বন্ধুদের কলেজে পাওয়া গেছে বিধায় নতুন বন্ধু বানানোর জন্য সময়ও অপচয় করতে হয়নি।
কলেজ আর স্কুলের ক্লাসরুমের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, এখানে স্যাররা বলতেন, তোমার যদি ক্লাস ভালো না লাগে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে, আমার অনুমতি নেয়া লাগবে না। স্যারদের এই বদান্যতায় আমার পাখনা ফুলে ফেঁপে বড় হতে সময় লাগলো না। আর তাই কলেজে প্রথম কিছুদিন ক্লাস করলেও এরপর থেকে ক্লাস করা পুরোপুরি ছেড়ে দিলাম।
আপনারা আবার ভাববেন না যেন, আমি কলেজে যাচ্ছি না। আমি তখনো অতটা অবিবেচক হইনি। আমি নিয়মিতই কলেজে যেতাম। প্রতিদিন খুব সকালে কলেজে এসে ক্লাসরুমে না ঢুকে সোজা চলে যেতাম কেন্টিনে। কেন্টিনের বারান্দাটা ছিল পুকুরের উপরে ঝোলানো। পুকুরের ওপাড় থেকে এলোমেলো বাতাস পানির উপর দিয়ে শীতল হয়ে আমাদের গায়ে এসে লাগতো। সকাল সকাল এখানে না এলে বারান্দার দখলটা বেহাত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল।
এই বারান্দায় বসেই চলতো তাস খেলা। সাথে সাথে চলতো চা-সিঙ্গারা। এমন করতে করতে কোন কোন দিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেতো। কখনোবা কমন রুমে দাবা বা টেবিল টেনিস খেলায় সময় পার করতাম। আবার কখনো, ফুটবল বা ক্রিকেট খেলে দিন কাটিয়ে দিতাম। কলেজ থেকে বাসায় ফিরে পেটে কিছু দানাপানি ভরে আবার বিকালে বের হতাম। রাত নয়টা-দশটার আগে বাসায় ফেরার কথা আর মনেই থাকতো না। পড়াশোনা বলে যে একটা বিষয় জীবনে আছে তা যেন ভুলেই গিয়েছিলাম। এসব করে করেই আমার পাখনা দিনকে দিন বড় হতে লাগলো। এখন এই পাখনায় ভর করেই আমি ইচ্ছে মতো উড়ি, ইচ্ছে মতো ঘুরি। সত্যি বলতে কী, পুরো কলেজ জীবনে আমি দুই মাসও ক্লাস করিনি। আমার এসব মহান কর্মের ফল পেলাম, টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্টে।
যতদূর মনে পড়ে আমার বন্ধু আহাদ টেস্ট পরীক্ষায় প্রথম হলো। মোর্শেদ, সাজ্জাদ ও অন্যরাও প্রথম দিকে স্থান করে নিলো। আর আমি ফোর্থ সাবজেক্টে ফেল করলাম (এখনকার জেনারেশনের জানার জন্য বলি, এই সাবজেক্টে ফেল করলেও তা ফেল বলে ধরা হতো না)। আর সব মিলিয়ে আরো এক নম্বর কম পেলে সেকেন্ড ডিভিশনও পাওয়া হতো না। সেই সময়ে যখন বন্ধুদের চোখে-মুখে বোর্ড স্ট্যান্ড করার স্বপ্ন ঘুরঘুর করছে তখন আমি
চোখে মুখে অন্ধকার দেখছি। এইচএসসি পরীক্ষার আর চার মাস আছে। এখন আমি কী করবো? কীভাবে এতো পড়া পড়বো? বইগুলো রান্না করে বা চিবিয়ে খেলেও তো কোন কাজ হবে না। কী ভাবে মান-সম্মান বাঁচাবো? আমার বড় হয়ে উঠা পাখনা হঠাৎ করেই মুখ থুবড়ে পড়লো। কোন কিছুতেই আর শক্তি পাচ্ছি না, স্বস্তি পাচ্ছি না। নাটক সিনেমা গান সবই বিস্বাধ লাগছে। খেলাধুলা করতে ইচ্ছে করে না। কী যে করবো তা ভেবে ভেবে কোনই কূল-কিনারা পাচ্ছিলাম না। জীবন যেন হঠাৎ করেই এক গহীন অন্ধকারে ডুবে গেলো।
এরপর মনে মনে নিজেকে বোঝালাম, আমি তো এভাবে হেরে যেতে পারি না। যতটুকু সময় আছে, আমাকে চেষ্টা করেই যেতে হবে। মনকে স্থির করে শুরু করলাম আমার জীবনের নতুন রুটিন। খুব ভোর বেলা উঠে নামাজ পড়ে পড়তে বসতাম। গোসল, খাওয়া-দাওয়া আর একটি কোচিং সেন্টারে সিলেবাস ভাগ করে পরীক্ষা দেয়া ছাড়া এই বসা থেকে আমাকে কেউ উঠাতে পারতো না। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়। দুপুর গড়িয়ে রাত আসে। রাতও একসম গভীর হয়ে যায়। মাঝে মাঝে আম্মা রাত জেগে আমার ঘুমানোর অপেক্ষায় বসে থাকেন। বলেন, অনেক পড়েছিস এবার ঘুমাতে আয়, নয় তো শরীর খারাপ করবে। কিন্তু আম্মার কথা শুনলে কী চলবে? আমার তো আরাম করার সময় নেই। আম্মা মাঝে মাঝে চা-নাস্তা এনে দেন। আমার এ অবস্থায় বড় ভাই বা ছোট বোন কেউই আমাকে বিরক্ত করে না। আমার এই জ্ঞান সাধনা চলতে থাকে দিনের পর দিন। এমনি করে যখন পরীক্ষার আর কিছুদিন বাকি, তখন আমার মনে হলো যদি কোনভাবে আমার ভয় পাওয়া সাবজেক্ট, ইংরেজি পরীক্ষাটি ভালো হয়ে যায়, তবে আমি স্ট্যান্ড করে যেতে পারি। স্ট্যান্ড করা মানে বোর্ডে প্রথম বিশজনের মধ্যে থাকা।
অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, প্রথম পরীক্ষাটিই ছিল সেই বিজাতীয় ভাষা, ফিরিংগীদের ভাষা ইংরেজি। প্রথম পরীক্ষা খারাপ হলে যা হয়। প্রথম দিনই বোর্ড-স্ট্যান্ড কারার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। তাই পরের পরীক্ষাগুলোর জন্যেও উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম।
তবু পরীক্ষা শেষ করে বুঝলাম, এ যাত্রায় আমার কোট-টাই পরা না হলেও অন্ততঃ আত্মরক্ষা হয়ে যাবে। তাই পরীক্ষা শেষ হলেও পড়া শেষ করে দিলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আমরা গ্রুপ করে পড়তে লাগলাম। আহাদ, মোর্শেদ, সাজ্জাদ আর আমি মিলে ছিল আমাদের গ্রুপ। আমরা ভিন্ন কোচিং সেন্টারে পড়ি। সবাই মিলে একাধিক কোচিং সেন্টারের শীট ও একাধিক গাইড বই সলভ করি। একসাথে আড্ডা দেই, একসাথে খেলি, একসাথে ঘুরতে যাই। আড্ডাতেও পড়াশোনা থাকে, খেলাতেও পড়াশোনা থাকে, ঘোরাঘুরিতেও পড়াশোনা থাকে।
রেজাল্টের দিন আম্মাকে বলে গেলাম, রেজাল্ট যদি খারাপ হয়, তবে আমি আর বাসায় আসবো না। আম্মা ভয় পেয়ে গেলেন। আমার পিছু পিছু গোপনে কলেজে চলে এলেন। এতো হাজার হাজার ছাত্রের মাঝে তিনি তো আর আমাকে খুঁজে পাবেন না। তাই পরিচিত বন্ধুদের কাউকে দেখলেই, আমার কথা জিজ্ঞেস করছেন। এদিকে আহাদ ছাড়া, বাকিদের রেজাল্ট আশানুরূপ হলো না। একমাত্র আহাদই স্ট্যান্ড করেছে। বাকিরা ফাস্ট ডিভিশন। আম্মাকে আশ্বস্ত করে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। বললাম, “আমি কোথাও যাবো না। বাসায় ফিরতে একটু দেরি হবে”।
এই হতাশাজনক রেজাল্ট পাওয়ায় আমাদের জেদ আরো বোড়ে গেলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আমার আরো বেশি পড়াশোনা করতে লাগলাম। প্রতিটি বই পুরো ঝাঁঝরা করে ফেললাম। কী রকম ঝাঁঝরা করলাম, তার একটি উদাহরণ দেই। যদি সিরাজুদ্দৌলা নাটকের যেকোন অংশ থেকে একটি ডায়লগ কেউ বলতো, তখন এটি কে কখন কোন কারণে বলেছে, এটি নাটকের কোন পর্বে, কোন দৃশ্যে সব বলে দিতে পারতাম। একাউন্টিং এর এমন কোন সমস্যা ছিল না, যে আমি আর আহাদ সমাধান করতে পারতাম না।
এরকম তুখোড় প্রিপারেশন নিয়েও পরীক্ষার আগের রাতে ঘুমাতে পারিনি। শুধু মনে হতো, পারবো তো? চাচ্ছিলাম প্রশ্ন কঠিন হোক, তাহলে আমরা পারবো। এসএসসি ও এইচএসসির স্কোরের উপর ডিপেন্ড করতে হবে না। অন্যদের তুলনায় আমার স্কোর ছিল সবচেয়ে কম।
শেষে পরীক্ষা খুব ভালো দিলেও মন থেকে সংশয় দূর হচ্ছে না। কেননা, কমার্স ফেকাল্টির কম্পিটিশন ছিল সবচেয়ে বেশি। আসন সংখ্যা কম। সেই তুলনায় পরীক্ষার্থী অনেক বেশি।
সেদিন ছিল শুক্রবার। আজিমপুর ছাপরা মসজিদের দোতলায় আমরা জুমার নামাজ পড়ছি। নামাজে সালাম ফেরানোর পরই পেছন থেকে এক বন্ধু জানালো, ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। মসজিদ থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স ফেকাল্টিতে চলে এলাম। আমার রোল নম্বর ছিল, ০১৩৫৭। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। একবার দু’বার তিনবার দেখি। তবু মনে হয়, ভুল দেখলাম নাতো? বন্ধুদেরকে বলি দেখার জন্য। ওরাও দেখে। না, ঠিকই আছে। আমি বাহাত্তর তম হয়েছি। এই সিরিয়ালটি স্কোর সহ। স্কোর ছাড়া আমার অবস্থান তৃতীয়।
চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ঝরছে। কিছুতেই কান্না আটকাতে পারছিলাম না। এ আনন্দ প্রকাশের কোন ভাষা আমার জানা নেই। আমাদের বংশের কেউ কোনদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ছাত্র হিসাবে পড়েনি। আল্লাহ আমাকে সেই সৌভাগ্য দান করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ্। বাসায় যখন ফিরছি, তখনো চোখের পানি ঝরছে। আব্বা-আম্মাকে সালাম করলাম। ওনারা আমাকে ভীষণ আবেগে জড়িয়ে ধরলেন। একটি স্বপ্ন পূরণ হলো। এ স্বপ্ন পূরণের গল্প জীবনে কখনো ভুলবো বলে মনে হয় না। প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে আমি এ স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছি। এ গল্প আমি কতজনের কাছে যে করেছি, তার হিসাব নেই। আরো কতজনের বাছে বলবো তারও হয়তো হিসাব থাকবে না।
এসএসসির সময় বিমানে কক্সবাজার নিয়ে যাওয়ার জন্য আব্বা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এখন তা পূরণ করার জন্য টাকা দিলেন। আমরা বন্ধুরা বিমানে না গিয়ে সড়ক পথেই কক্সবাজার চলে গেলাম। সাগরের লবন পানিতে দাপিয়ে চেহারা-সুরত কালো কুচকুচে করে এক সপ্তাহ পরে যখন বাসায় ফিরলাম, তখন আমাদের কেউ চিনতেই পারছিল না। ভাগ্যিস, গলার স্বরটি বদলে যায়নি, নয়তো বাসায় ঢোকাই দায় হয়ে যেতো।।
সংগৃহীত